স্বপন বিশ্বাস : সেদিন রোববার ৮ আগস্ট, ১৯৭১ সাল। অবরুদ্ধ ঢাকার বাসিন্দা’দের ভেতর তখন শুধুই নির্যাতনের ভয় ও মৃত্যুশঙ্কা। তবুও, মানুষ আশাবাদী হয়েছিল সেদিন। কারন, মৃত্যুপুরী ঢাকায় স্বাধীনতাকামী দুর্ধর্ষ গেরিলাদের সরব ও প্রত্যক্ষ উপস্থিতি।
এইদিন পাকিস্তানী জল্লাদদের উপস্থিতির মাঝেও, অবরুদ্ধ ঢাকাবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ঢাকার অন্যতম স্মরণীয় গেরিলা অপারেশন। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকায় সমুখ যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে জুন মাসের শুরু মাস থেকে ডিসেম্বরে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবার মুহূর্ত পর্যন্ত তটস্থ করে রেখেছিলেন ‘গেরিলা’ যোদ্ধারা।
এবং একাত্তরের আগস্ট মাস জুড়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বিস্ময়ের সাথে দেখেছিল একের পর এক দুঃসাহসী গেরিলা অভিযান পরিচালিত হচ্ছে ঢাকা জুড়ে, এমনকি দিনের বেলাতেও।
⚫ “অপারেশন ফার্মগেট” ⚫
🔴 তারিখঃ ৮ আগস্ট রোববার ১৯৭১ সাল।
🔴 সময়ঃ রাত আটটার আশেপাশে।
🔴 স্থানঃ ফার্মগেট, রাজধানীর কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, এর অদূরেই ক্যান্টনমেন্ট।
ফার্মগেট অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন, ছ’জন দুর্ধর্ষ গেরিলা মুক্তিয়োদ্ধা। শহীদ বদিউল আলম বদি বীর বিক্রম, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, হাবিবুল আলম বীর প্রতীক,পুলু , কামরুল হক স্বপন বীর বিক্রম এবং আবদুস সামাদ বীর প্রতীক।
একাত্তরের ২৫শে মার্চের রাতে, পাকিস্তানী হিংস্র পশুদের অমানবিক, নির্দয়, পাশবিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার ফার্মগেটে একটি চেকপোস্ট স্থাপন করেছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। সে সময় নির্মাণাধীন আনন্দ সিনেমা হলের উপরে ছিল মেশিনগান। তার থেকে সোজা বরাবর সামনেই ট্রাফিক আইল্যান্ডে তাঁবু খাটানো ফার্মগেট চেকপোস্ট। ভেতরে-বাইরে ভারি ও হাল্কা অস্ত্র হাতে সজ্জিত পাকিস্তানী মিলিটারি ও রাজাকার। ফুটপাথে চলমান টহল বজায় রেখেছে এরা।
মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৭ই আগস্ট অপারেশনের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল আবদুস সামাদের ইস্কাটনের বাসায়। সারাদিন ব্যাপী রেকি করলেন হাবিবুল আলম, মায়া চৌধুরী, এবং বদিউল আলম। পুরো ফার্মগেট রেকি করা হয়। সারাদিন সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হলেও, সন্ধ্যার দিকে মিলিটারি পুলিশের টহল বেড়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় স্বচক্ষে দেখে এলেন হাবিবুল আলম, বদিউল আলম এবং কামরুল হক স্বপন। অভিযান অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ বোধ হওয়াতে এবং সাধারন মানুষের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে দিনের বেলায় আক্রমণের সিদ্ধান্ত পেছানো হয় এবং ৮ই আগস্ট আক্রমণের তারিখ পুনঃনির্ধারণ করা হয়।
৮ই আগস্ট, সন্ধ্যা ৭ঃ১৫ মিনিটে জিরো আওয়ার নির্ধারণ করেন গেরিলারা। ১৯৬৫ সাল মডেলের একটি ‘মেটালিক গ্রিন’ টয়োটা সেডান গাড়িতে করে তাঁরা অভিযানে বের হন। গাড়িটি আবদুস সামাদ বীর প্রতীকের, এবং তিনি সেদিন অসাধারণ দক্ষতায় গাড়ি চালিয়েছিলেন। অভিযানে অংশ নেয়া সকল গেরিলার মাঝে তিনি ছিলেন বয়স্ক সদস্য।
ইস্কাটন থেকে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে তৎকালীন পাক মোটরে এসে (বাংলা মোটর) ডানে মোড় নিয়ে ধীরগতিতে এগুতে থাকে। এসময় বর্তমান সোনারগাঁও হোটেলের কাছে ‘দারুল কাবাব’ রেস্তোরাঁর সামনে দুটি জীপ গাড়িতে পাকিস্তানী সেনাদের দেখা পাওয়া যায়। তারা জীপে বসে পা ছড়িয়ে কাবাব খাচ্ছিল। রাস্তাটি সেসময় ময়মনসিংহ রোড ( বর্তমান কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ) নামে পরিচিত ছিল।
সেদিন, গেরিলারা গাড়িতে করে তেজকুনিপাড়ার বেশ কিছু রাস্তা ঘুরে হলিক্রস স্কুল পেরিয়ে ফার্মগেটের মুখে থামলো। ড্রাইভিং করছিলেন সামাদ, পাশে বদিউল আলম ও হাবিবুল আলম, পেছনের সিটে জানার পাশে মায়া ও স্বপন মাঝে পুলু। অমিয় তেজী গেরিলা হাবিবুল আলম ক্ষিপ্র গতিতে গাড়ি থেকে নেমে এলেন, একই সাথে বাকি আলোর পথের যাত্রীরা। চোখের পলকে অবস্থান নিতেই গর্জে উঠলো পাঁচটি স্টেনগান ও এলএমজি।
প্রায় সোয়া মিনিট স্থায়ী এ অভিযানে, গেরিলা’দের বার্স্টফায়ারে মুহূর্তের মাঝে তিন পাকিস্তানী সেনাসদস্য কাটা কলাগাছের মতই মাটিতে পড়ে, সাথে তাঁবুর ভেতর আরও নিহত হয় ৮/৯ জন। প্রত্যক্ষদর্শী’র বর্ণনা থেকে জানা যায় ভোর বেলায় পাকিস্তানী সেনারা ট্রাকে করে ছুটে আসে, বালতি বালতি পানি ঢেলে রক্ত পরিষ্কারের চেষ্টা করে এবং ১২ টি মৃতদেহ অপসারণ করে।
এই গেরিলা অপারেশন,ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল পুরো ঢাকায়। নতুন উদ্যম যোগ করেছিল গোটা দেশের মুক্তিকামী জনমানুষের মনে। ক্যান্টনমেন্টের এত নিকটে এমন দুর্ধর্ষ গেরিলা অভিযান খোদ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছেই ছিল অবিশ্বাস্য এক ঘটনা।
পরদিন ঢাকা শহরব্যাপী পাকিস্তানী সেনাদের চোখেমুখে আতঙ্ক ছিল স্পষ্ট। চেকপোস্ট ছিল ফাঁকা, ফার্মগেট ছিল জনশুন্য।
অপারেশন ফার্মগেটের ৫১ তম বার্ষিকীতে, সকল শহীদ ও বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধার প্রতি আমাদের হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি।
🔴 তথ্য সূত্র ও কৃতজ্ঞতাঃ
অপারেশন ফার্মগেটে অংশ নেয়া দুর্ধর্ষ গেরিলা, হাবিবুল আলম বীর প্রতীক।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তেজকুনিপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা স্বর্গীয় জন স্যামুয়েল গমেজ (২৭ এপ্রিল ২০১৮, তাঁর দেহাবসান হয়েছে)।