মৃত্যুর পরে ( কবিগুরু)
যত কিছু ভালোমন্দ
যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব
কিছু আর নাই ।
রোষানলে এমনই পুড়েছিলেন তিনি যে মৃত্যুর পর তিনদিন তাঁর দেহ মর্গে পড়েছিলো, দাহকার্য হয়নি।
এখানে কবিগুরুর “মৃত্যুর পরে “কবিতাটি সংযোজন করতে হলো কারণ যতোক্ষণ মানুষ বেঁচে থাকে তার সময়কালে সমসাময়িক মানুষ জন তাঁর কীর্তি চোখে দেখতে পায়না শুধু টীকাটিপ্পনী বিদ্রুপ করতে থাকেন মধু কবিও তার শিকার হয়েছিলেন।
Dipti Mitra.
আজ শ্রদ্ধেয় কবি মধুসূদন দত্তের জন্মদিন।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ‘প্রথম বিদ্রোহী কবি’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলা প্রেসিডেন্সির যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের এক নামকরা উকিল, রাজনারায়ণ দত্ত ও তাঁর প্রথমা স্ত্রী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান ছিলেন মধুসূদন।।
তাঁর ছদ্মনাম- ‘টিমোথি পেনপোয়েম’।
তিনি ১৩-১৪টি ভাষা জানতেন।
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অমিত্রাক্ষরে লেখেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য। এরপর একে একে রচিত হয় ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ (১৮৬১) নামে মহাকাব্য, ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য (১৮৬১), ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য (১৮৬২), চতুর্দশপদী কবিতা (১৮৬৬)।
সেকালের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি মধুসূদনের কিছুমাত্র অনুরাগ ছিল না। তাঁর সৃজন পিয়াসী মননকে তখন দখল করে রেখেছে ইংরেজি ভাষা আর শেক্সপীয়ার, বায়রন, শেলীর মতো হওয়ার স্বপ্ন। তাঁর মন উচাটন হয়ে থেকেছে শেক্সপীয়ার, বায়রনের দেশে পা রাখার প্রবল বাসনায়। সেকালের হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতার বাধার মুখে বিলেত যাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। সমাজপতিদের রোষানলে পড়ে জাতিচ্যুত হতে হত। সেই বাধা অতিক্রম করতে উনিশ বছর বয়সে তিনি খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করবেন বলে মনস্থির করেন। আর এভাবেই ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী মধুসূদন খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর নামকরণ হয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
এসময় তিনি হিন্দু কলেজ পরিত্যাগ করে শিবপুরের বিশপস্ কলেজে ভর্তি হন এবং চার বৎসর সেখানে অধ্যয়ন করেন। এখানে অধ্যয়নকালে তিনি গ্রীক, ল্যাটিন, ফরাসী, হিব্রু প্রভৃতি ভাষা আয়ত্ব করেন। খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করায় মধুসূদন দত্ত পিতার অর্থ সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন। আত্মীয় পরিজন পরিত্যক্ত হয়ে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তারপর ১৮৪৭-এর শেষের দিকে মধুসূদন এক তামিল সহপাঠীর সাহায্যে মাদ্রাজ চলে গেলেন। মধুসূদন সেই আট বছর মাদ্রাজ প্রবাসকালে কলকাতায় আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কোন যোগাযোগই রাখেন নি। এমনকি পিতা, মাতার মৃত্যু সংবাদও পান নি। সকলেই মধুসূদনকে মৃত বলে ধরে নিয়েছিলেন। মাদ্রাজে প্রথমে তিনি ‘মেল অরফ্যান অ্যাসাইলাম’ বিদ্যালয়ে ইংরেজী শিক্ষকের চাকরি গ্রহণ করেন। পরে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন।
১৮৪৯ সালে ‘মেল অরফ্যান অ্যাসাইলাম’ -এ শিক্ষকতা করার সময় তিনি রেবেকা ম্যাক্টাভিলকে বিবাহ করেন। কয়েকবছর পরে ১৮৫৫ সালে রেবেকার সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মধুসূদন তখন দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক । একই বছরের ডিসেম্বরে ফরাসী নারী এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়াকে বিবাহ করেন। মাদ্রাজ প্রবাসকালে তাঁর সাহিত্য প্রতিভা উজ্জ্বীবিত হয়ে ওঠে। এই সময়ে তিনি লিখলেন ‘ক্যাপটিভ লেডি’ ও ‘ভিশনস্ অব দ্য পাস্ট’। এখানে তিনি কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। তাঁর ইংরেজি ভাষায় প্রথম নাটক ‘Riza’ (Empress of India) এখান থেকেই প্রকাশিত হয়।
মাদ্রাজ প্রবাসকালে মধুসূদনের প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ক্যাপটিভ লেডি’ পড়েন ভারতপ্রেমিক শিক্ষাবিদ ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন। তাঁর সাহিত্যকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে শিক্ষাবিদ বেথুন মত প্রকাশ করেন যে, “এরকম সাহিত্যপ্রতিভা নিজ মাতৃভাষায় নিয়োজিত হলে সেই সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে”। বাল্যবন্ধু গৌরদাস বসাক বেথুনের প্রশংসাবাণীটি মধুসূদনকে জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। তিনি আরও লিখলেন, “আমরা ইংরেজি সাহিত্যে আর একজন বায়রন কিংবা শেলি চাই না, আমরা চাই বাংলা সাহিত্যে একজন বায়রন কিংবা শেলি”। বেথুনের প্রশংসাবাণী ও গৌরদাসের পত্র মধুসুদনকে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার প্রত্যয় জাগিয়ে তুলেছিল। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি সকালে প্রায় রিক্ত হাতে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে এলেন। মধুসূদনের বয়স তখন বত্রিশ বছর। বন্ধুদের সহায়তায় তিনি পুলিশ কোর্টে কেরাণির পদে একটি কাজ পেলেন।
লিখলেন…
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি; –
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে –
“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।
বাংলা নাটকের জগতে আকস্মিক ভাবেই মাইকেল মধুসূদন দত্তের আবির্ভাব।বাংলা নাট্যকার রূপে মধুসূদন দত্তের আত্মপ্রকাশ ও অবদানে আমাদের দেশে বাংলা নাটকও মঞ্চস্থ হতে থাকে।
ইংরেজ সাহেবরা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের বিনোদনের জন্য এদেশে থিয়েটার আমদানি করেছিল। পলাশি যুদ্ধের পর ইংরেজরা তখন এদেশে পাকাপোক্ত হয়ে বসেছে। কলকাতাকে নগর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সব রকমের উদ্যোগ নেয়া শুরু হয়েছে। সে সময় লালবাজারের কাছে ইংরেজরা ‘প্লে হাউস’ প্রতিষ্ঠা করে। বাংলা থিয়েটারের ধারণাটি তখনও কারো কল্পনাতে ছিল না। মধুকবিই প্রথমে বাংলা নাটক তাঁর লেখা মহাকাব্য থিয়েটারে আনেন।
প্রথম জীবনে বিদ্রুপ সহ্য করতে হলেও মৃত্যুর পুর্বে
তিনি যশস্বী হয়েছিলেন, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র
তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন..
“মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে যশস্বী হইয়া মরিয়াছেন, ইহাতে বুঝা যায় যে, বাঙ্গালা দেশ উন্নতির পথে দাঁড়াইয়াছে।”
আজ আমাদের প্রিয় মধুকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই।
#diptimitra.