ঢাকাশনিবার, ২৫শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, দুপুর ২:২৩
আজকের সর্বশেষ সবখবর

যৌতুক

ESAHARA NEWS অনলাইন নিউজ পোটাল
ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৩ ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ
পঠিত: 40 বার
Link Copied!

যৌতুক

বিয়ের তৃতীয় দিনে বাবার দেওয়া যৌতুকের টাকা নিয়ে শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সঙ্গে আবার বাপের বাড়ি যাচ্ছি।

আর গাড়িতে বসে বসে বিয়ের ফাইনাল কথা হওয়ার দিনটার কথা মনে করছি।

সেদিন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আমাকে দেখতে গেলে বাবা তাদের বলেছিলেন, জানেন মশাই, আমার কিন্তু চাকরি করার কোন ইচ্ছে ছিলোনা, চাকরিটা করছি শুধু মেয়েটার জন্য।মেয়েটার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলে কিন্তু সব ছেড়ে দেব।
আমার শ্বশুর তখন বললেন, তো ছেলেদের জন্য কিছু করবেন না?

বাবা হেসে বলেছিলেন, ছেলেরা নিজেরাই নিজেদের জন্য করুক ভাই,আমি আর পারবোনা।

শ্বশুর মশাই তখন বাবার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বললেন,মশাই,মেয়ের কি কোন দোষ-ঘাটতি আছে?ওর জন্য কেন খাটতে হবে? ওর কি ছেলেপক্ষের পছন্দ হওয়ার কোন গুণ নেই?

বাবা কিছুটা বিচলিত হয়ে জবাব দিলেন, তা হবে কেন মশাই।আমার মেয়ে তো মাশাল্লাহ অনেক সুন্দরী, পড়াশোনাও এমবিএ ফাইলান।
–তাহলে,আমার শ্বশুর প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসালেন।
বাবা শ্বশুর মশাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে নিজ থেকে বিয়ের দেনা-পাওনার কথা বললেন।

শ্বশুর মশাই নির্লজ্জের মতন হেসে হেসে বললেন, আমি ওসব জিনিসপত্র চায় না ভাই,বাড়িতে সব আছে।তবে আমার টাকার দরকার। আমাদের যৌতুক বাবদ পাঁচ লক্ষ টাকা দিলে হয়ে যাবে।

শ্বশুরের চাওয়ার আগে বাবা প্রমাণ করে দিয়েছেন, উনি সারাজীবন খাটুনিটা আমার জন্য খেটেছেন। তাই ওই তাই হবে তাই হবে বলে পাত্রপক্ষের কথামতো রাজি হয়ে গেলেন। তারপর আমার শ্বাশুড়ি কথা তুললেন।
–বিয়াই মশাই,আজকালতো সমাজের একটা রীতি হয়ে গেছে।বিয়ের দিন বরপক্ষকে খাওয়ানো। তো আপনারও নিশ্চয় একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পরিকল্পনা ছিলো, তার বিয়েতে আপনি হাজার লোক খাওয়াবেন?

হ্যা, আমার বাবার সত্যি সেরকম একটা স্বপ্ন ছিলো।উনার সঙ্গে আড্ডায় কিংবা কোন বিয়ে বাড়িতে গেলে উনাকে কতোবার যে বলতে শুনেছি, যেভাবে পারি তোর বিয়েতেও আমি হাজার লোক খাওয়াব।তোর সব ইচ্ছে পূর্ণ করব,শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে মাথা উঁচু করে থাকার মতন ব্যবস্থা করে দেবো।
তাই এবারও বাবা শ্বাশুড়ির কথামতো হ্যা হ্যা করে হেসে উঠলেন।

তবে শ্বাশুড়ি মা বাবার সে হাসি বেশিক্ষণ টিকতে দিলেন না।বললেন, আমাদের ভাই আত্মীয়-স্বজন অনেকবেশি। তারমধ্যে অনেক গণমাণ্য মানুষও আছেন। তাদের খাবার-ধাবারে একটু বেশি সচেতন হতে হবে বোঝেনই তো।
বাবা একটু স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন তারপর।

শ্বাশুড়ি বলে গেলেন,তবে মেয়ে যখন আমাদের পছন্দ হয়েছে,আপনার সামনে একটা প্রস্তাব রাখছি ।আপনি নিশ্চয় আপনার মেয়ের বিয়ের দিন বরপক্ষকে খাওয়ানোর জন্য দুই লক্ষ টাকার হিসেব কষে রেখেছেন,এর চেয়ে কম টাকায় তো আর সম্ভব না।
বাবা তাতো হবেই বলে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন।

উনি বলে গেলেন, তো বলি কি ভাই,আপনি বরং আমাদের সেই টাকাটা দিয়ে দিন,আপনাদের জন্যতো আমরা আর আমাদের মানসম্মান খোয়াতে পারবোনা। বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে আমরা লোকজনকে বলে দেবো,আমরা আপনাদের থেকে পরিমাণমত যা নেওয়ার তা নিয়ে নিয়েছি।

এতে আপনিও বাঁচলেন আমরাও বাঁচলাম, কি বলেন?

বাবারও যেহেতু ছেলেকে ভীষণ রকমের পছন্দ হয়েছিল,উনিও আমার দিকটা ভেবে উনাদের কথামতো রাজি হয়ে গেলেন।

দরজার ওপাশ থেকে উনাদের সেসব কথাবার্তা শুনে আমার সেদিন মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়েছিল, মেয়ে হয়েছি নাকি দোকানের কোন মাল? যা নিতে গেলে দরাদরি করে নিতে হবে।আর লোকগুলোও বা কেমন লোভী? বিয়েটা আমি করবোনা বলে বাবার সামনে কথা তুললেও বাবা বলেছিলেন, এই একটা বিয়ে না-হয় আমি মানুষগুলো লোভী বলে করলাম না।তবে একদিন না একদিন ঠিকই করতে হবে,আর তখনও সমাজের নিয়মতো মানতে হবে।আর ওরা না চাইলেও আমার খুশির জন্য এবং আত্নীয়-স্বজনদের হাত থেকে বাঁচার জন্য হলেও সংসার সাজে এমন সব জিনিস দিতে হবে।

এরপর বিয়েটা হয়ে গেলো আমাদের। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল বিয়ের তৃতীয় দিন।সকালে নাস্তার টেবিলে বসে শ্বশুর মশাই বললেন, বৌমা,খেয়ে তৈরি হয়ে নাও।আজ তোমার বাপের বাড়ি যাবো

আমি কথাটার মানে তৎক্ষনাৎ না বুঝে খুশি হলেও শ্বশুর যখন শ্বাশুড়ি মাকে বললেন সাত লাখ টাকা ঠিকঠাকভাবে নিয়েছে কিনা তখন হুঁচোট খেলাম।

কি বলতে চাইছেন উনারা! বললাম, বাবা আপনাদের কথাটা আমি ঠিক বুঝলাম না।যাবো তো বেড়াতে,সেখানে আবার সাত লক্ষ টাকা সঙ্গে নিবেন কেন?

তখন আমার শ্বাশুড়ি মা হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, শুনো বৌমা,তুমি আমাদের খারাপ ভাবতে পারো কিন্ত লোভী না,আমরা তোমার বাবার সঙ্গে বড় খেলাটা খেলেছি।তুমি রাগ করোনা।

রাগ! রাগ কেন করবো মা? আপনারা বাবার সঙ্গে খেলেছেন মানে বুঝলাম না।

শোন বৌমা,আমরা সেদিন তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম শুধু তোমাকে আমাদের বাড়িতে বউ করে নিয়ে আসবো বলে,আমাদের ছেলেকে ভেড়া-মহিষের মতোন বিক্রি করবো বলে নয়।কিন্তু তোমার বাবা আমাদের কি লজ্জায় না ফেলে দিলেন।

আসলে তোমার বাবারও দোষ কোথায় বলো।উনিও সমাজের রীতিমতোই ধরে নিয়েছিলেন, আমরাও যৌতুক নিয়ে ছেলেকে বিয়ে দেবো,যৌতুক ছাড়া তোমাকে আমরা আমাদের ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবোনা। তাই উনি রীতিমতো আমাদেরও সব বলেছিলেন।

আমি এবার সত্যি চুপ হয়ে গেলাম। মানুষগুলো কি বুঝাতে চায় তা আন্দাজ করতে পেরে খানিক লজ্জাও পেলাম আবার প্রফুল্লও হলাম।কারন,আমি আমার জীবনে এমন দুজন ভালো মনের মানুষকে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি হিসেবে পেয়েছি।
শ্বশুর মশাই বললেন, এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই মা।আমরা সেদিন টাকা টা এইজন্য দাবি করে নিয়েছিলাম যে,আমরা যদি তোমার বাড়ি থেকে কিচ্ছু নেবো না বলতাম, তোমার বাবার যা অবস্থা বুঝেছিলাম। উনি জোর করে হলেও তোমাকে খুশি করার জন্য ফার্নিচার-আসবাবপত্র ঠিকই কিনে দিতেন। যা কি-না আমাদের বাসায় অপ্রয়োজনীয়,তুমি দেখতেই তো পাচ্ছ সেটা।আমাদের শুধু প্রয়োজন ছিল একটা ছেলের বউ,যে কিনা আমাদের পরিবারটাকে নিজের পরিবারের মতন করে ভালোবাসবে।সবকিছু নিজের মতন করে সামলে নিবে।

তুমি তো দেখতে পাচ্ছো মা,আমাদের সামর্থ্য আছে, ওসবের আমাদের কোন দরকার নেই।কিন্তু তোমার বাবা এবং ভাইয়েরা?বিয়াই মশাইয়ের কথা শুনে বুঝেছি, ওরা তো তোমায় বিয়ে দিয়ে সর্বস্ব হারাবে। আমাদের সব থেকেও কিভাবে ডাকাতের মতন একটা পরিবারকে নিঃস্ব করতে পারি বলো?
এরপর আমি কোন কথা বলিনি।

শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সঙ্গে বাবা-মায়ের বাড়ি চললাম। গাড়িতে বসা দুজন ভালো মানুষকে তাদের ছেলেকে উপদেশ দিতে শুনলাম, তোর শ্বশুরের বৌমাই ছিলো পরিবারের হাল ধরা লোক।আমরা সেটা কেড়ে নিয়েছি।বেয়াই মশাইয়ের বয়স হয়েছে, দুই ছেলে ছোটো ছোট এখনো।তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোর বেতনের অর্ধেক টাকা মাসিক উনাদের হাতে পৌঁছে দিবি।মনে রাখিস, বৌমাকে যেমন আমরা মেয়ে হিসেবে গছিয়ে নিয়েছি তোকেও তারা ছেলে হিসেবে মেনেই নিয়েছে।তুই ছেলের মতোন দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য।

আমি চুপচাপ সব শুনছি।চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে।একবার সে জল মোছার চেষ্টা করলাম। পরক্ষণে ভাবলাম,এই জলতো লজ্জার জল নয়,মুছবো কেন?আমিতো চিরো ভাগ্যবান,আর এই জল সুখের জল।যাদের জন্য এই সুখ,তারাও দেখুক আমি কতোটা খুশি। বলেই চললাম আমার মতোন বাবারও ভুল ভাঙাতে…বাবাও জানি আমার মতোন প্রথমে অবাক হবেন লজ্জা বোধ করবেন। তারপর সেও গর্ববোধ করবেন, এমন মানুষগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারার আনন্দে।

©স্বর্ণালি রহমান #রিপোস্ট #Bangladesh #story #takingoverbd #সংগৃহীত #life #novel #সংগৃহীত #সত্যঘটনাঅবলম্বনে #সত্যঘটনা_অবলম্বনে #অনুগল্প

%d bloggers like this: